গরিব মানুষের সার্বিক কল্যাণ ও উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক-কে অবিস্মরণীয় বূমিকায় অবতীর্ণ করে প্রকারান্তরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধনে সম্পূরক ভূমিকা পালনকারী ড. আতিউর রহমানের কদর সামান্যতম কমেনি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ফোরামে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর পদ ত্যাগের পর বরঞ্চ আরো বেশি সমাদৃত হচ্ছেন ‘অন্তর্ভুক্তিকরণ অর্থনীতি’তে আগ্রহীদের কাছে। অবাক বিস্ময়ে সাবেক এই গভর্ণরের অভিজ্ঞতা শ্রবণ করছেন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং ভারতীয় অর্থনীতিবিদরা। খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছেও ড. আতিউর একটি অনুকরণীয় নামে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ একাউন্ট থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার চুরির বহুল আলোচিত/সমালোচিত পরিস্থিতির মধ্যে দীর্ঘ ৭ বছর গভর্ণর হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ড. আতিউর ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ পদত্যাগ করেছেন। এরপরও তাকে আন্তর্জাতিক সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণের আগ্রহ হ্রাস পাওয়া দূরের কথা, ক্ষেত্র বিশেষে আরো বেড়েছে।
‘গরিবের ব্যাংকার’ হিসেবে সমধিক পরিচিত ৬৬ বছর বয়েসী প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, লেখক-শিক্ষক ড. আতিউরের দিনকাল কেমন কাটছে, সে ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেয়ার সময় এনআরবি নিউজ জানতে পেরেছে যে, পদত্যাগের পর থেকে এ বছরের ৬ জুলাই পর্যন্ত তাকে ১৭টি আন্তর্জাতিক সেমিনার/সম্মেলন/ওয়ার্কশপে অংশ নিতে হয়েছে।
এর মধ্যে ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্বব্যাংকের সেমিনার ছাড়াও অস্ট্রেলিয়ায় সিম্পোজিয়াম, সংযুক্ত আরব আমিরাতে গোল টেবিল বৈঠক, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, নয়াদিল্লী, কলকাতা, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানে অনুষ্ঠিত সেমিনারে বক্তব্য দেন তিনি। জাপান, কলকাতা, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রে কয়েকটি সিম্পোজিয়ামেও তিনি বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন বিশেষ আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে।
তিনি গত বছর জুনের ৯ তারিখে অস্ট্রেলিয়ায় ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ম্যাক্রো ইকনোমির অবদান : বিনিয়োগের সম্ভাবনা’ শীর্ষক সিম্পোজিয়ামে বক্তব্য রেখেছেন। বিশ্বব্যাংকের আমন্ত্রণে গত বছরের সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখে ওয়াশিংটন ডিসিতে ‘অর্থ ব্যবস্থাপনা উদ্ভাবন : বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’, ‘সবুজ অর্থনীতি এবং টেকসই উন্নয়ন : বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা’, ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি এবং প্রবৃদ্ধি : বাংলাদেশের গল্প’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তব্য রেখেছেন ড. আতিউর।
গত বছর ২৪ অক্টোবর থেকে দুবাইতে ৬ দিনব্যাপী এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ‘উন্নয়নশীল দেশে টেকসই অর্থায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালনার নীতি ও ভ’মিকা’ সম্পর্কে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। জাপানে গত ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সেমিনারে ড. আতিউর ‘সামাজিক সমৃদ্ধিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি : বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ’বিবৃত করেছেন। গত ১৩ নভেম্বর সিঙ্গাপুরের সেমিনারে ‘বাংলাদেশ-অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির সিলিকন ভ্যালি : বাস্তবতার আলোকে উপস্থাপনা’ শীর্ষক বক্তব্য দিয়েছেন তিনি।
মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে গত ১৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সেমিনারে ড. আতিউরের বক্তব্যের বিষয় ছিল ‘অর্থনৈতিক সেবামূলক শিল্পকারখানায় মানবিকতার বিকাশ : ভবিষ্যত উন্নয়ন এবং চ্যালেঞ্জ’ ।
ফিলিপাইনের মেনিলায় গত ২১ নভেম্বর এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সেমিনারে ‘উন্নয়নশীল দেশে টেকসই অর্থায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালনার নীতি ও ভ’মিকা’ শীর্ষক বক্তব্য রেখেছেন ড. আতিউর।
১১ ডিসেম্বর নয়াদিল্লী, ১৪ ডিসেম্বর কলকাতা, ৫ জানুয়ারি কলকাতা, ১৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতা, ১৬ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাটে কুইনিপিয়াক ইউনিভার্সিটি, ২০ এপ্রিল কানাডায় ইউনিভার্সিটি অব সাসকেচওয়ান, ৪ মে জাপানে এশিয়ান ডেভেলপমেন্টের সেমিনারে অংশ নেন তিনি।
ড. আতিউর এসব শিক্ষামূলক সেমিনার/সিম্পোজিয়ামে তার সময়কালে অর্থাৎ ২০০৯ সাল থেকে ২০১৬ সালের মার্চ পর্যন্ত ৭ বছরে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক-কে কীভাবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকে মুক্ত করে দেশের গরীব-দুঃখী মানুষের পাশাপাশি গোটা দেশের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামোর উন্নয়নে সম্পৃক্ত করেছিলেন, তা উপস্থাপন করেছেন। বিশেষ করে কৃষক, শ্রমিক শ্রেণির মানুষের জন্য তাদের ঋণ সুবিধা শুধু নয়, সন্তানদের লেখাপড়ার সুবিধার জন্য সিএসআর সাপোর্ট, এমনকি বাড়িতে যারা কাজ করেন, রিকশাওয়ালাসহ দিনমজুর শ্রেণির মানুষ সহজেই যাতে লেনদেন করতে পারেন তার জন্য মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে একটা ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স ব্যবস্থা তৈরি করেন বলেও ডক্যুমেন্টসহ উপস্থাপন করেন।
বাংলাদেশের গরিব দুঃখী মানুষ এই ধারার অর্থায়ন ব্যবস্থার সুবিধে পেয়ে খুবই সন্তুষ্ট বলেও উল্লেখ করেছেন এসব সেমিনারে। একজন রিকশাওয়ালা, গার্মেন্টস শ্রমিক, ক্ষুদে ব্যবসায়ী বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং সুবিধে পাচ্ছেন। প্রতিদিন তারা শত শত কোটি টাকা লেনদেন করছেন। ফলে গ্রামীণ মানুষের ভোগ বেড়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা রয়েছে। অতি দারিদ্রের মাত্রা কমেছে বলে সেমিনারে উল্লেখ করার পাশাপাশি এসব উদ্ভাবনী পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কমিটমেন্টের প্রসঙ্গও উল্লেখ করেছেন অকৃপণভাবে।
ড. আতিউর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে সাধারণ অধিবেশনের প্রেসিডেন্ট আয়োজিত সর্বশেষ গত জুন মাসের সেমিনারে গভর্ণর হিসেবে তার দায়িত্ব প্রসঙ্গে বলেছেন যে, ২০০৯ থেকে ২০১৬ এর মধ্যে সাত বছরের দায়িত্ব পালনকালে দেশের অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধনে সম্পূরক ভূমিকা রেখেছেন।
২০০৯ সালে বিশ্বমন্দা যখন বাঘা বাঘা অর্থনীতির দেশগুলোকে শক্তভাবে জেঁকে ধরে, সেরকম একটি নাজুক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব পান তিনি। বিশ্বমন্দার চোখ রাঙানির মাঝেও সময়োচিত এবং উৎপাদনশীল মুদ্রানীতি ও ঋণনীতির মাধ্যমে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়েছেন অপ্রতিরোধ্য গতিতে। মূল্যস্ফীতিকে নামিয়েছেন এক অঙ্কের ঘরে। একইসঙ্গে ব্যাংকিং সেবা মানুষের দৌরগোড়ায় নিতে সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন। বর্গাচাষী ও কৃষক থেকে শুরু করে সবাই আজ ব্যাংকিং সুবিধা পাচ্ছেন। অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের এক বিরল উদাহরণ তৈরি করেছেন তিনি।
২০০৮-০৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৫.০৫ শতাংশ। বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি মন্দার পরিবেশেও অর্থবছর ২০১৪-১৫ এর ৬.৫৫ শতাংশসহ গত সাত বছরে এই হার ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। সরকারের পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতের উৎপাদনমুখী ভূমিকার কারণে ম্যাক্রো অর্থনীতির এই স্থিতিশীলতা ও পারদর্শিতা দেশে বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে এবং হচ্ছে।
বিশ্বের কোন উন্নত দেশেরই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন পর্যন্ত সরাসরি জনগণের কল্যাণে সম্পৃক্ত হয়নি। তারা শুধু অধীনস্থ ব্যাংকসমূহের কার্যক্রম মনিটরিং করাকেই একমাত্র দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এমন গতানুগতিক ব্যবস্থা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক-কে মুক্ত করতে ড. আতিউরের নেতৃত্ব সর্বত্র প্রশংসিত হচ্ছে এবং কোন কোন দেশে বাংলাদেশের এই ধারা অনুসরণের চিন্তা-ভাবনা চলছে বলেও জানা যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ড. আতিউর এনআরবি নিউজকে বলেছেন, ‘আমার পক্ষে এসব করা সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অকুন্ঠ সমর্থন থাকায়। জনগণের কল্যাণ হয়-এমন যে কোন কাজে আমি তাঁর সমর্থন পেয়েছি সব সময়। তার মত নেতা খুব কমই পাওয়া যাবে অন্য কোন দেশে। আর এ কারণেই শেখ হাসিনা বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে দেশ-বিদেশে সুনাম কুড়াচ্ছেন।’
একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের গেরিলা ড. আতিউর পদত্যাগের পরই ফিরে গেছেন তার পুরনো কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক ড. আতিউর আন্তর্জাতিক পর্যায়েও কয়েকটি পুরস্কার পেয়েছেন মানবতার সমৃদ্ধির প্রত্যাশায় লেখালেখির জন্যে।
আরও জানা গেছে, ভারতে বিশ্ব ভারতী ইউনিভার্সিটিতে এ মাসেই অনুষ্ঠিতব্য ‘ঠাকুরের সামাজিক-অর্থনৈতিক ভাবনা’ তথা রবীন্দ্রনাথের কৃষি ও সমবায় বিষয়ক এক সম্মেলনে যোগ দিতে যাচ্ছেন ড. আতিউর। একই সময়ে তিনি কাটস ইন্টারন্যাশনালের (ঈটঞঝ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ) একটি সেমিনারেও অতিথি হিসেবে অংশ নেবেন। সামনের মাসে যাবেন ন্যাদারল্যান্ডে ‘অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি’ শীর্ষক এক সেমিনারে অংশ নিতে। ন্যাদারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।
এরপর যাবেন মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্ণরদের এক সম্মেলনে প্রধান বক্তা হিসেবে। সেখান থেকে ফিরেই আবার ইউএন এস্কেপ সম্মেলনে অংশ নিতে যাবেন ব্যাংককে। এ ক্ষুদ্র-উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীদের উত্থানে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বক্তব্য প্রদানের এ আমন্ত্রণ একইসাথে এশিয়া ফাউন্ডেশনও দিয়েছে বলে এ সংবাদদাতাকে ৫ আগস্ট জানিয়েছেন ড. আতিউর।